ইচ্ছা মতো এলপিজির গ্যাসের মূল্য আদায়, বিক্রেতাদের কারসাজি

নিউজ ডেস্ক , আমাদের ভোলা.কম।

দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে আসছে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে না সরকার। আবার যাদের সংযোগ আছে তারাও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পান না। ফলে দৈনন্দিন রান্না মেটাতে লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এ সুযোগে গ্রাহকের কাছ থেকে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ইচ্ছা মতো আদায় করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এ খাতে চলছে ‘নৈরাজ্য’, বাড়তি মূল্যে বিপাকে ক্রেতা ও সাধারণ মানুষ!

এদিকে এলপিজি সরবরাহকারী একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। দেশে এখন বাৎসরিক চাহিদা ১০ লাখ টনের মধ্যে। আর বিপিসি মাত্র ১৬ হাজার টন সরবরাহ করে। সরকারি এলপিজি কোম্পানির দুটি কারখানার বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১৫ হাজার ৫০০ টন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের এলপিজি কারখানার ১০ হাজার আর কৈলাসটিলা প্ল্যান্টে উৎপাদন হয় ৫ হাজার ৫০০ টন।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সর্বশেষ নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী, সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের সরকারি মূল্য ৬০০ টাকা। এটি সরকারের নিজস্ব উৎপাদিত এলপিজি মূল্য। কিন্তু বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, টোটাল, বিএম এলপি গ্যাস, এনার্জিপ্যাকের জি গ্যাস, লাফ্স গ্যাস, ইউরোগ্যাস, ইউনিভার্সাল, যমুনা ও সেনা এলপিজি। এসব প্রতিষ্ঠান বিপিসি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেশি দামে অর্থাৎ ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি করছে এলপিজি। এমআরপি অর্থাৎ সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ না থাকায় ইচ্ছা মতো মূল্য আদায় করছে তারা।

lpg-01

মুগদার খুচরা এলপিজি বিক্রেতা ইমরান জানান, একটি এলপিজি কেনা পড়ে ৮৫০ টাকায়। বিক্রি হয় ৯০০ টাকায়। বাসায় পৌঁছে দিলে ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকা নেয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজিসহ জ্বালানির দাম কমেছে। এজন্য আমরা ভোক্তাপর্যায়ে যে এলপিজি ৭০০ টাকা ছিল সেটি কমিয়ে ৬০০ টাকা করেছি। শুধু এলপিজি নয় অন্যান্য জ্বালানির দামও কমানো হয়েছে।’

‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাজারে এলপিজির দাম বেশি কেন? এর মূল কারণ বিপিসি বাজারের চাহিদার ২ থেকে ৩ শতাংশ সরবরাহ করতে পারে। বাকি ৯৮ শতাংশ বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে। তাই আমাদের দাম কমলেও বাজারে তেমন প্রভাব পড়ে না। বেসরকারি কোম্পানিগুলো এলপিজি আমদানি করে, তারাই মূল্য নির্ধারণ করে বাজারে ছাড়ে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তাদের এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। তাদের মূল্য কত হবে, এ ধরনের পলিসি বা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ৬০০ টাকা নিচ্ছি, তারা ৯০০ টাকা নিচ্ছে কেন— এটা তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে আমি মনে করি, এখন ভোক্তাপর্যায়ে এলপিজির দাম কমানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম এখন কম।’

এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ আছে কি-না, জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান জানান, দাম নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। নীতিমালাও নেই। এলপিজি যেহেতু সরকার এককভাবে আমদানি করে না, তাই এটির দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবে অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে যাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভোক্তাপর্যায়ে সর্বনিম্ন দাম রাখতে বাধ্য হয়। এছাড়া বিপিসির পক্ষ থেকে দাম কমিয়ে তাদের ব্যবসায়িক প্রেশার দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা দাম কমায়। পাশাপাশি বেসরকারিপর্যায়ে এলপিজির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া যায় কি-না, বিষয়টি আমরা চিন্তাভাবনা করছি। কীভাবে করা যায়, সে বিষয়েও খোঁজখবর নিয়ে তারপর মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর চিন্তা আছে।

বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের হেড অব অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স মাহবুব আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের ডিলার প্রাইজ ৭৮০ টাকা। এটি এক বা দুই হাত ঘুরে ভোক্তাপর্যায়ে যায়। বাজারে বিক্রি হয় সাড়ে আটশ থেকে ৯০০ টাকায়।’ সরকারের দামের সঙ্গে পার্থক্য হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সরকার নিজেরা উৎপাদন করে আর আমরা আমদানি করি। সরকার যেহেতু উৎপাদন করে তাই তারা তাদের নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে পারে। আমাদের আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির মূল্য ওঠা-নামা করে। বিশ্ব বাজারে এলপিজির দাম বাড়লে আমাদের বাড়িয়ে বিক্রি করতে হয়, আর দাম কমলে কমিয়ে দেই। আমাদের নির্ধারিত কোনো মূল্য নেই।’

একই কথা বলেন বেক্সিমকো এলপিজি গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার মো. মেহেদী হাসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন বেক্সিমকোর এলপিজির এমআরপি (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) দেয়া আছে ৯০০ টাকা। ভোক্তাপর্যায়ে এটি ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়।’

সরকারের চেয়ে বেক্সিমকোর এলপিজির দাম বেশি কেন— জানতে চাই প্রতিষ্ঠানটির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার যে দামে এলপিজি দেয় ওই দামে আমাদের বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ সরকার উৎপাদন করে; আর আমাদের সম্পূর্ণভাবে আমদানি করতে হয়। সরকার বাজারে দুই শতাংশের মতো এলপিজি সরবরাহ করে বাকিটা বেসরকারি অর্থাৎ আমাদের সরবরাহ করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে যে মূল্য রয়েছে তাতে দেশের বাজারে এলপিজি এক হাজার টাকায় বিক্রি করা দরকার। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাই আমরা বাজারে টিকে থাকার জন্য ৯০০ টাকায় দিচ্ছি।’

মুগদার নিজাম উদ্দিন নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, নতুন গ্যাস লাইনের সংযোগ দেয়া বন্ধ। তাই গত ছয় বছর ধরে এলপিজি দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। প্রতি মাসে দুটি এলপিজি সিলিন্ডার লাগে। প্রতিটি সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার বাসায় দিয়ে যায়, এক হাজার টাকা নেয়। সরকার ৬০০ টাকায় দিচ্ছে কিন্তু আমরা তো পাই না। আমাদের এক হাজার টাকা দিতে হয়। গত পরশু সিলিন্ডার নিলাম। এক টাকাও কম নিল না। একটি সিলিন্ডারে ৪০০ টাকা বৈষম্য! আমাদের সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে, দেখার যেন কেউ নেই!

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক (উপ-সচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘একেক জায়গায় একেক মূল্যে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির কথা শুনছি। আইন অনুযায়ী এলপিজি সিলিন্ডারের গায়ে মূল্য লেখা বাধ্যতামূলক। এ বিষয়ে অধিদফতর ঢাকাসহ সারাদেশে অভিযান চালাচ্ছে। এলপিজির গায়ে খুচরা মূল্য বা এমআরপি না থাকলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। এছাড়া গ্যাস কম দিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে কি-না, সেই বিষয়েও আমরা তদারকি করছি। ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা ‘নিরাপদ খাদ্য ও ভোক্তা অধিকার আন্দোলন, বাংলাদেশ’-এর প্রধান নির্বাহী কামরুজ্জামান বাবলু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা, ভোক্তারা যেন ন্যায্য মূল্যে পণ্য বা সেবা পায়। বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমরা সামাজিক আন্দোলন করছি। এলপিজি নিয়ে দেশে একটা নৈরাজ্য চলছে। যে যার ইচ্ছা মতো দাম হাকাচ্ছে। ভোক্তার স্বার্থে এটি বন্ধ করা জরুরি। আমরা চাই, সরকার সাড়ে ১২ কেজি এলপিজি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন একই দামে বিক্রি করে এবং সেটা নিশ্চিতে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে— এটাই প্রত্যাশা।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বাজারে সাড়ে ১২ কেজি, ৩০ কেজি, ৩৫ কেজিসহ বিভিন্ন মাপের সিলিন্ডারে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়। এর মধ্যে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার বাসাবাড়ি এবং হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয় ৩০ ও ৩৫ কেজির সিলিন্ডার।

সূত্র – জাগো নিউজ২৪

ফেসবুকে লাইক দিন

আর্কাইভ

এপ্রিল ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« মার্চ    
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  

সর্বমোট ভিজিটর

counter
এই সাইটের কোন লেখা অনুমতি ছাড়া কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ!
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।