সাংবাদিকের যে অনুসন্ধান পুলিশের জন্যও প্রেরণার -সিআইডির পুলিশ সুপার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম

অনলাইন ডেস্ক, আমাদের ভোলা.কম।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত দুই বছরে যে ৪৬ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ তার নেপথ্যে রয়েছে একজন সাংবাদিকের গভীর অনুসন্ধান। টানা দুই বছর ধরে তার ঐকান্তিক চেষ্টা ও কৌশলে একে একে উন্মোচিত হয়েছে প্রশ্নফাঁসকারীদের চেহারা। তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল২৪-এর অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান ‘সার্চ লাইট’ এর প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আল ইমরান। এ কাজে তার সঙ্গে পরবর্তীতে সিআইডি যুক্ত হয়ে দুটো বড় প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের শেকড় পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। গ্রেফতার অভিযুক্তরাসহ ১৩০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে চার্জশিট। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অপরাধে জড়িতদের খুঁজে বের করা ও অপরাধী শনাক্তে এমন সহযোগিতার জন্য আব্দুল্লাহ আল ইমরানকে বৃহস্পতিবার (৩১ জানুয়ারি) ‘আউটস্ট্যান্ডিং জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করেছে সিআইডি।
সাংবাদিক ইমরানের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সাংবাদিক ও পুলিশ একসঙ্গে কাজ করলে কাজটা অনেক বেশি স্বচ্ছ হয়। অগ্রগতিও হয় দ্রুত। এরকমই একটি কাজ ছিল আমাদের। আমরা সফলভাবে প্রশ্নফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত চক্রের মূল উৎপাটন করতে পেরেছি। ভবিষ্যতের এ ধরনের আরও ভালো কাজ করে জনগণের সেবা করার আশা রাখছি।’
নিজের এই অনুসন্ধানের সাফল্য ও শুরুর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল ইমরান।
যেখান থেকে ভাবনা
ইমরান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রশ্নফাঁসের অনেক নিউজ দেখেছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বা প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ, রাত এতটার সময় প্রশ্নফাঁস হয়েছে, ডিভাইসসহ এতজন গ্রেফতার, এগুলো। আমার মাথায় সবসময় ছিল, প্রশ্নটা কোথায় থেকে আসলো? বা এই ডিভাইসটা দেয় কারা। আমার যখন চ্যানেল ২৪ এর কাজ করার সুযোগ হলো, তখন আমি একটা প্রস্তাব দিলাম যে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আমি ডিটেইল কাজ করতে চাই। আমার অফিস অনুমতি দিলো।’

প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে আটক হওয়া ৯ ব্যক্তি। পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার হাতে এমন আটক ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে মাঝে মাঝেই। (ফাইল ছবি)
প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে আটক হওয়া ৯ ব্যক্তি। পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার হাতে এমন আটক ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে মাঝে মাঝেই। (ফাইল ছবি)
অনুসন্ধান যেভাবে শুরু
‘কিছু মানুষের নাম জানতে পারলাম, যারা এই কাজটি করে। এটা জানার পর তাদের কাছে আমি একজন পরীক্ষার্থী পাঠালাম, যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিতে চায়। যাদের কাছে পাঠালাম, তাদের সঙ্গে ফোনালাপ ও সামনাসামনি কথা বলে আরও কিছু নাম পেলাম, যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজ করে। যাদের নাম পাওয়া গেলো, তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে নক দিয়ে কথা বললাম। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করার পর তাদের একজন আমাকে সহযোগিতা করার জন্য রাজি হলো।’ বলছিলেন আব্দুল্লাহ আল ইমরান।
শুরুর টার্নিং পয়েন্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমাকে সহযোগিতা করবে বলে সম্মতি দিলো তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৮তম হয়েছে একজন, যে প্রশ্নপত্র পেয়ে চান্স পেয়েছে। এই একটামাত্র ক্লু পেলাম। আমি নামও জানতাম না। পরে দেখলাম ৪৮তম তিনজন। তাদের মধ্য থেকে একজনকে ফাইন্ড আউট করে তার সঙ্গে কথা বললাম। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে তাকে ব্রেকডাউন করে ফেললাম। ও স্বীকার করলো। তার দেওয়া তথ্য ধরে কাজ শুরু করলাম। এভাবে কাজ শুরুর পর একের পর এক লেয়ারের কাছে পৌঁছাতে লাগলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, এক সময় এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূলে পৌঁছাতে পারবোই। কোনও না কোনও জায়গা থেকে এই প্রশ্ন ফাঁস হয়। কোথায় থেকে কারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে চায়, আমি সেটা জানতে ও জানাতে চেয়েছি।’
প্রথম সাফল্য
২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কাজ শুরু করার চারমাসের মধ্যে প্রথম সাফল্য আসে বলে জানান সাংবাদিক ইমরান। তিনি জানান, ‘২০১৭ সালের জুলাইতে কাজ শুরু করি। যার প্রথম সাফল্য আসে ১৯ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে অভিযান চালিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত রানা ও মামুন নামের দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এ ঘটনায় ২০ অক্টোবর শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতারকৃত দুই শিক্ষার্থীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরীক্ষা হল থেকে গ্রেফতার করা হয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী রাফিকে। এরপর গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্য ও প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়া সাত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (সিআইডি)।

ঢাবিতে গতবছর ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মূল প্রশ্নের (ডানে) মিল। (ফাইল ছবি)
ঢাবিতে গতবছর ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মূল প্রশ্নের (ডানে) মিল। (ফাইল ছবি)
সিআইডি যেভাবে ইমরানের অনুসন্ধানে যুক্ত হয়
সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরানের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর অভিযান পরিচালনা করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। ইমরান বলেন, ‘পুলিশ প্রথমে আমার তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে ১৯ অক্টোবর। সেটা ছিল ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে। অভিযানে কয়েকজন গ্রেফতারের পর একটা পর্যায়ে হয়তো নানা কাজের চাপে সিআইডির অনুসন্ধান মন্থর হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি থেমে যাইনি।’
ইমরানের অনুসন্ধান অনুসরণ করেছে পুলিশ
ডিজিটাল ডিভাইস চক্র গ্রেফতারের পর সিআইডির তৎপরতা ও এ নিয়ে কাজ অনেকটা থমকে থাকে বলে জানান ইমরান। ‘পরবর্তীতে আমি আমার মতো করে, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কাজ চালিয়ে যাই। আমার লক্ষ্য ছিল কোথায় থেকে কারা ফাঁস করে জেনে তাদের পরিচয় ফাঁস করা। সাধারণত অনেক ক্ষেত্রে আমরা পুলিশকে ফলো করি। এক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। আমাকে অনুসরণ করেছে পুলিশ। আমি যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কাজ শুরুর পর মাঝামাঝি পর্যায়ে চলে গেলাম তখন সিআইডিকে জানালাম, যে আমি কিন্তু অনেকদূর এগিয়েছি। তখন তারা এসে আবারও যুক্ত হলো। আমাকে ফলো করলো। তারা আমাকে টেকনিক্যাল হেল্প করেছে। এই দীর্ঘ অনুসন্ধানে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি সুমন কুমার দাশ বেশ সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে মোল্যা নজরুল ইসলাম যদি আমাকে এতটা বিশ্বাস না করতেন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন না হতেন, তবে অনুসন্ধানটি হয়তো মাঝপথেই পথ হারাতো। তবে অধিকাংশ কাজ আমার অনুসন্ধান ছিল। জড়িতদের নানা সোর্স, ফাঁদ, কৌশল করে বের করেছি।

সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান
সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান
অফিসের সহযোগিতা
দুইবছর টানা একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে অফিসের সহযোগিতা অনেক বেশি জরুরি ছিল বলে জানান চ্যানেল ২৪ এর সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান। তার ভাষ্য, ‘আমার এই কাজটা প্রায় দুই বছরের। শুরুতে একটা টেনশন ছিল, অফিস আমাকে এই সুযোগটা দেবে কিনা। অফিস আমাকে সেই সুযোগটা দিয়েছে এবং আমি সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছি। অফিসকে টাইম টু টাইম আপডেট জানিয়েছি। অফিস ও আমার কাজের মধ্যে সমন্বয় ভালো ছিল। এজন্য আমি অফিস ও আমার টিম মেম্বারদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
এখন যা চাওয়া
প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের পরিচয় পাওয়া গেছে, গ্রেফতারও হয়েছে ৪৬ জন। বাকিদের চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এখন চাওয়া জড়িত ছাত্রদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি অন্যদের আদালতে বিচারের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা। এটা এখনকার চাওয়া বলে জানিয়েছেন ইমরান। তিনি আরও বলেন, ‘একটা সময় পর্যন্ত প্রশ্নফাঁস যে হয় সেটা প্রশাসন মানতে চাইতো না। প্রমাণসহ আমি উপস্থাপন করেছি। এখন আমার চাওয়া, তথ্য প্রমাণসহ যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ অন্য যারা আছে তাদের আদালত শাস্তির মুখোমুখি করবে। এই দুটো জিনিস না হওয়া পর্যন্ত আল্টিমেটলি লাভ নেই। এখানে মার্কেট ইকোনোমি একটা ফ্যাক্ট। শত কোটি টাকার বাজার রয়েছে। যা অনেককেই এই পথে টেনেছে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে ভবিষ্যতে আর কেউ এই পথে পা বাড়ানোর সাহস পাবেন না।’
যে ভুল ভেঙেছে
ইমরান বলছিলেন, ‘আমিসহ সাধারণের একটা ধারণা ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও শিক্ষক হয়তো জড়িত। কিন্তু সুখবর হলো এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। আমাদের শিক্ষকরা একটুও নিচে নামেননি। এছাড়া বড় কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে পাবো ভেবেছিলাম। তাও ঘটেনি। তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাইনি। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের নাম এসেছে। তারাও খুব প্রভাবশালী বা শীর্ষ পদধারী এমন কেউ না।’
শিক্ষকরা প্রশ্নফাঁসে জড়িত না হলেও কখনও কখনও তাদের অবহেলার কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে জানান ইমরান। তিনি বলেন, ‘প্রেস থেকে প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে সরাসরি শিক্ষক জড়িত এমন কাউকে আমার অনুসন্ধানে পাইনি। এটা অনেক স্বস্তির জায়গা। তবে কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অবহেলা পেয়েছি। যে অবহেলার কারণে প্রশ্নগুলো প্রেস থেকে ফাঁস হয়েছে। যেমন ধরুন, ২০১৫-১৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন যে প্রেস থেকে ফাঁস হয়েছে, সেখানে অনেক অবহেলা ছিল শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলদের। ডিন মহোদয় কোনও ধরনের নিরাপত্তা ছাড়া প্রশ্নপত্র ছাপিয়েছেন। সে সুযোগটা প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা কাজে লাগিয়েছে।’

(সূত্র – বাংলাট্রিবিউন)

ফেসবুকে লাইক দিন

আর্কাইভ

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

সর্বমোট ভিজিটর

counter
এই সাইটের কোন লেখা অনুমতি ছাড়া কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ!
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।