ডাকাত!

গ্রামটির নাম কন্যাদাহ। কাঁচা রাস্তা দিয়ে পানি কাদা পার হয়ে বেশ কিছু দূর পায়ে হেটে পৌঁছলাম দু’জন দু’জন করে। আগে থেকেই রেকি করা স্থানের রাস্তা পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতে অবস্থান নিলাম আনুমানিক ২০০ গজ দূরুত্বে দু’দলে বিভক্ত হয়ে।

সামনের দলের নেতৃত্বে চৌকষ সাব-ইন্সপেক্টর মোল্লা খালিদসহ ৪ জন ওরা রেসকিউ পার্টির দায়িত্বে। আর আমার নেতৃত্বে ৪ জনের মূল অ্যাকশন পার্টি।

অল্প কয়েকদিন ডিবিতে চাকরীর সুবাদে প্রতিটি অপারেশনের সময় শুরুর আগেই একাধিকবার মিটিং করে সেরে নিয়েছি আ্যকশন প্রক্রিয়া। এবারো তার ব্যতিক্রম করলাম না। কারন প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আগেই ধারনা হয়েছিল অপারেশন সাকসেস হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।

ডাকাত দলের দলত্যাগ করা সদস্যের তথ্য অসত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আজ রাতে এই এলাকায় গন ডাকাতি হবে। ওরা সংগবদ্ধ ডাকাত। ইতোপূর্বে অনেক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। ওদের ধরতে না পারলে এলাকার মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার ধরতে গেলে ব্যাপক গোলাগুলি আর হতাহতের সম্ভাবনা রয়েছে। জীবনহানির ব্যাপক রিস্ক থাকার পরও তাতে পিছপা না হয়ে পরিকল্পনা মোতাবেক এসপি স্যারের সাথে কথা বলে অভিযানের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া।

একটু বাঁকা গ্রামের রাস্তাটার পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতের পানির মধ্য কোনরকমে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে শিকারের অপেক্ষা। রাস্তার বিপরিত পার্শ্বে ২০০ গজ দূরত্বে রেসকিউ পার্টির অবস্থান। শিকার আসবে এ পথেই। বর্ষাকাল, গভীর রাত, হালকা জোসনা, জোঁকের ভয়েও অনেকক্ষন যাবত পানিতে ঠায় দাড়িয়ে ! আর যে তর সয় না!!

জনমানব শূন্য এলাকায় মাঝে মাঝে ঘুঘরো পোকা আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া কোন শব্দ নেই। পাশের সহকর্মীর টেনশনে জোরে জোরে শ্বাস ফেলানোর শব্দ বেশ স্পষ্ট। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে টার্গেটের কোন দেখা নেই।

হঠাৎ দূরে ঈষৎ আলোর দৃশ্য। জোনাকি ভেবে প্রথমে বিভ্রম। এবার একই রকম দু’টো আলো দেখে জলন্ত সিগারেট আঁকাবাঁকা করে এগিয়ে আসছে মনে হল। সাথে সাথে হার্টবিটও বেড়ে গেল।

ধানক্ষেতের মধ্যে রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকা প্রথম দলটাকে ক্রস করলো। আগুন দু’টি আরেকটু কাছাকাছি আসতেই হালকা জোসনায় লক্ষ্য করলাম ওরা ৮/১০ জনের দল। সবার মালকোচা দিয়ে লুঙ্গি পরা। কয়েকজনের হাতে চকচকে বড় দা।

সর্টগানের ট্রিগারে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে পাশের সহকর্মি বললো “স্যার গুলি করি”? বিপরিত পার্শ্বে থাকা পার্টির গায়ে লেগে সেম সাইড হতে পারে ভেবে বললাম, “একটু পরে”।বীরদর্পে এগিয়ে আসছে টার্গেট। কাছাকাছি আসতেই লক্ষ্য করলাম ওদের হাতে আরো অনেককিছু। তা যা থাকুক, শিকারের নেশায় কান মাথা গরম হয়ে আসছে, কপালও ঘামছে।

মাথা উঁচু করে রাস্তায় উঠলাম। ওদের সামনে বুক পেতে বললাম, “কারা আপনারা”? জবাবে ওরা বললো, “তোরা কারা”? পুলিশ পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথেই ওদের কয়েকজন বড় দা দিয়ে মাথায় কোর মারলো। কোনরকম সরে গিয়ে মাথাটা রক্ষা করলাম। শুরু হল ধস্তাধস্তি, দৌড়াদৌড়ী।

এর মধ্যে ঠাস ! ঠাস গুলির আওয়াজ। আমাদের লক্ষ করে ওয়ান শ্যুটার গানের গুলি। আল্লাহপাক কিভাবে যেন বাচিয়ে দিলেন !! জিবন ফিরে পেলাম। ভয়ানক অবস্থা ! প্রায় ৫/৬ সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করলাম পাশের ধানক্ষেতে পানি কাদার মধ্যে। হাতের টর্চ লাইটটা দেখছি না। কে, কোথায় আছে বলতে পারছি না।

সহকর্মি কে যেন হাত ধরে কাদাপানি থেকে উঠিয়ে দিল।৪/৫ সেকেন্ড পর আবারো গুলির আওয়াজ, সাথে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার ! ভয় ধরে গেল খুব!! আমার নিজের লোকজন গুলিবিদ্ধ হলো নাতো !! ব্যাপক উৎকন্ঠা!!

কিন্তু কোনদিক দিয়ে আওয়াজ আসছে অন্ধকারে তা ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না।এবার গুলির শব্দের দিক অনুমান করে ঐদিকে দৌড়ে গেলাম। কিছুদূর যেয়েই দেখলাম, তেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতার মত কাদাপানি মাখামাখি করা রক্তাত্ব অবস্থায় কয়েকজনকে। কে পুলিশ আর কে ডাকাত তা বোঝা মুশকিল । হাতে হ্যান্ডকাপ লাগানো যাচ্ছিল না পিচ্ছিল কাদার কারনে।

সহকর্মীর টর্চের আলোতে নিজের লোকগুলোকে চিনতে পারলাম। সবাই কমবেশি জখমপ্রাপ্ত। কারো শরীরে আচড়ের দাগ, কারো পা রক্তাত্ব। নিজেরও পা সামান্য মচকানো।

ওয়ান শ্যুটার গান আর দেশিয় অস্ত্রসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাতেনাতে ধরা পড়লো ৩জন ডাকাত।বাকিরা রাতের আধারে লুকিয়ে গেল। নিজের লোকগুলো গুনতে শুরু করলাম। ইতোমধ্যে গোলগুলির শব্দে দূরের কিছু লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে আসতে শুরু করলো।

রেসকিউ পার্টি বিপরিত পার্শ্বে না রাখলে খুব বিপদ হয়ে যেত অনুমান করলাম। পূর্বের পরিকল্পনা কাজে লেগে গেল।সাব-ইন্সপেক্টর মোল্লা খালিদের বিচক্ষনতায় ধরা পড়লো তিনজন।

রক্তাত্ব অবস্থায় ওদের নিলাম ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে। ওরা জনমানুষের প্রতি নির্দয় হলেও আমরা মানবিকতা দেখিয়ে নিয়ে গেলাম চিকিৎসার জন্য। সাথে আমরাও চিকিৎসা নিলাম। এবার ওদের সাজা নিশ্চিতের লক্ষ্যে শুরু হল লেখালেখির পালা। তাতেই রাত শেষে পূর্বাকাশে কখন যে সূর্য উঠে গেছে তা টের পেলাম না।

চাকরী জিবনের ঘটনাবহুল দিনগুলোর মধ্য সরাসরি পুলিশ ডাকাত পুলিশ গোলগুলির এই দৃশ্যটা কখনো ভুলতে পারিনা। আজও মানসপটে ভাসে, গা শিউরে ওঠে জিবন বেঁচে যাওয়া সেই ভয়াবহ রাতটির কথা মনে হলে !!

(পুলিশ পরিদর্শক কাজী ওয়াজেদ এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত )

ফেসবুকে লাইক দিন

আর্কাইভ

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

সর্বমোট ভিজিটর

counter
এই সাইটের কোন লেখা অনুমতি ছাড়া কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ!
দুঃখিত! কপি/পেস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।