মনপুরায় গরু পালনে চরাঞ্চলে নারীর ভাগ্যবদল
মনপুরা প্রতিনিধি।
আজকাল দেশের নারীসমাজও নিজেদের সদিচ্ছা এবং একাগ্রতায় ভাগ্য বদলাতে পারে। তাদেরই একজনের নাম ফাতেমা বেগম। বাড়ি চরফ্যাশন উপজেলার বিছিন্ন দ্বীপ ঢালচর। মহাজনের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে গরু লালন-পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তিনি।
শুধু ফাতেমা-ই না, মনপুরা উপজেলার বিছিন্ন দ্বীপ ইউনিয়নের সাকুচিয়া গ্রামের অনেক নারীর মধ্যে অনেকেরই গরু কেনার সামর্থ্য নেই। তাই মহাজনের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে গরু পোষেণ সম্ভাবনাময় চরে। বর্তমানে বর্গা গরুতে লাভবান হয়ে উঠেছে চরাঞ্চলের নারীরা। মেঘনা নদীর ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া নারী-পুরুষ জেগে ওঠা চরে বাসা গড়েছেন। এখানকার বাড়িগুলোর বেশির ভাগ পুরুষ সদস্য অন্যের জমিতে দিন মজুরির কাজ করেন। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন রেখে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন শহরে, যেখানে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সংসার চলে স্বামীর উপার্জনে। আর বাড়িতে অনেকটাই কর্মহীন সময় কাটান নারীরা।
চরের নারী আকলিমা বলেন, সংসারে বাড়তি আয় করতে তারা স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ছোট গরু বর্গা নেন। সেই গরু পালন করে বড় করে বিক্রি করেন। সেখান থেকে পাওনা টাকা মহাজনকে ক্রয় মূল্য দিয়ে বাকি যে টাকা থাকে তার অর্ধেক নিজেরা রাখেন, বাকি অর্ধেক মহাজনকে দেন।
কর্মহীন না থেকে এভাবে গরু পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন চরাঞ্চলের নারীরা। মজিন নগর ইউনিয়নের চরমোতাহার চরে অনেক পরিবার নিজেরদের উন্নতি করতে বিভিন্ন কর্মজীবি কাজে ধাবিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে ৩ থেকে ৪টি গরু, যার সবগুলোই বর্গা নেওয়া।
মনপুরা উপজেলা একটি দ্বীপ হলেও নারীরা রয়েছে খুবই সাহসি। কলাতলির চর, চর নিজামের অনেক নারীরাই এখন স্বাবলম্ভী হয়ে উঠেছে। কলাতলি চরের আকলিমা বেগম, জান্নাত আক্তার সোহেলী, জীবন্নেচ্ছা বেগমসহ অনেক নারীরা অনেক কষ্ট করে গরু পালন করছেন। অনেকে বিধবার তার পরেও জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি করতে এবং ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে থাকতে তাদের জীবন এখন খুবই পরিশ্রমী হয়ে উঠেছে। আকলিমা বলেন, এক সময় আমার সন্তান নিয়ে অন্যের দরজায় হাত পেতে যেতাম। ঋণ নিয়ে দু‘টি গরু ক্রয় করছি। আজ মায়ে চাও মিলিয়ে ৯টি গরু হয়েছে। আজ গরুর দুধ বিক্রি করে আমার সংসার চলছে। আমার ঈদে চান্দেও কোন স্থানে যাওয়া লাগেনা।
চরের বাসিন্দারা বলেন, চুরি-ডাকাতির কোনো ভয় নেই। চরের বিস্তির্ণ এলাকায় দিনভর চড়ে বেড়ায় এসব গরু। ফলে অল্পতেই বেশ মোটা-তাজা হয়ে ওঠে। এতে দামও মেলে বেশ ভালো।
চরের বাবু মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা বলেন, ‘চরে গরু পোষার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমাদের গরু কেনার টাকা নেই। তাই মূল ভূখন্ডে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ৪৮ হাজার টাকা নিয়ে দু’টি ছোট গরু কিনে নিয়েছি। এক বছর লালন-পালন করার পর বর্তমানে গরু দু’টির বাজার মূল্য প্রায় লাখ টাকা। মজিব নগরের বাসিন্দা আবুল কামাল বলছেন, আমরা দ্বীপে বসবাস করি। বন্যা বাতাসের মধ্যে আমারা বসবাস করছি। সরকারের কাছ থেকে আমারা ঋণ পেলে আমার আশার আলোটা আরে বেড়ে যেত।
চরের বাসিন্দা সালেহা আক্তার বলেন, নদী আমাদের সবই কেড়ে নিয়েছে। ব্যাংক থেকেও কোনো ঋণ পাই না। কারণ, চরের জমি খাস খতিয়ানে হওয়ায় ব্যাংক ঋণ দেয় না। অন্যদিকে যোগাযোগের সমস্যায় কিস্তি আদায় না হওয়ার আশঙ্কায় চরাঞ্চলের মানুষকে অনেক বেসরকারি সংস্থাও (এনজিও) ঋণ দিতে চায় না বলে জানিয়েছেন চরের বাসিন্দারা।
মনপুরা কলাতলির চরের বাসিন্দা মো. আবদুল আলিম বলেন, আসলে কোনো কোনো এনজিও ঋণ দেয়। তবে এ টাকায় গরু পালন সম্ভব নয়। কারণ, তাদের ঋণের কিন্তি পরের সপ্তাহে শুরু হয়। আর গরুর লাভ আসতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। এতে আরো ঋণের বোঝা বাড়ে। তাই সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন জানিয়েছেন চরাঞ্চলের নারী-পুরুষরা। চরকুকরি মুকরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন বলেন, চরাঞ্চলে অনেক পরিবার গরু পালনের প্রতিঝুকছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে বলেছি। এই সকল চরের নারীদেরকে উৎসাহিত করতে যেন ঋণকার্যক্রম দিয়ে তাদের আশা পুরণ করা হয়। কুকরি-মুকরি একটি কৃষি ব্যাংকও দাবী করেন এই ইউপির চেয়ারম্যান।
মনপুরার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আমি প্রাণি সম্পদকে নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকে সরকারি ভাবে কি সহযোগিতা করা যায় এবং তার জন্যে কোন সুযোগ আছেনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। নারীরা গরু পালনে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। তাদের জীবন যাত্রার মান সুন্দর কামনা করছি।