পুলিশ কনস্টেবলদের দিনরাত্রি
নিউজ ডেস্ক, আমাদের ভোলা.কম।
আবদুর রশিদ। পুলিশের কনস্টেবল। থাকেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ব্যারাকে। গতকাল রোববার সকাল থেকেই তার ডিউটি শুরু হয় পুলিশের রমনা জোনের পুলিশ ভবন ক্রসিংয়ে। তবে সকাল সাড়ে ৬টায় ডিউটিতে যোগ দিতে হবে বলে ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠতে হয় তাকে। প্রাত্যহিক প্রস্তুতি নিয়ে নাশতা সেরে গাড়িতে সকাল সাড়ে ৬টায় নির্ধারিত ডিউটিস্থলে আসেন তিনিসহ তার কয়েক সহকর্মী। ডিউটি শেষ হয় রাত ৮টায়। ব্যারাকে ফিরতে সময় লেগে যায় আরও বেশ খানিকক্ষণ। টানা ১২-১৬ ঘণ্টা ডিউটির কারণে রাস্তার পাশে বসেই খেতে হয় দুপুরের খাবার।
এভাবে প্রায় প্রতিদিনই আবদুর রশিদের মতো অনেক কনস্টেবলকে ১২-১৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। কখনও কখনও করতে হয় ১৬ ঘণ্টা। সারাদেশে মোট পুলিশের সংখ্যা দুই লাখ পাঁচ হাজার ৮৬০। এদের মধ্যে কনস্টেবল এক লাখ ২৫ হাজার ৩৫৪ জন। তাদের প্রায় সবাই এভাবে ডিউটি করায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যদিও দায়িত্ব পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা। কর্তব্য আর সংসার নিয়ে সূখে-দুঃখে জীবন কাটছে তাদের। অথচ তাদেরও রয়েছে চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-সাধ। আবদুর রশিদসহ রাজধানী ঢাকায় কর্মরত একাধিক কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা যায়।
গতকাল রোববার সমকালের সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডিউটিরত ২০ জন কনস্টেবলের কথা হয়। তাদের সবার কথাই অভিন্ন- তাদের কিছু চাওয়া-পাওয়া রয়েছে সরকারের কাছে। নিজেদের বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি সম্মান রেখেই তারা সেই চাওয়া-পাওয়ার কথা তুলে ধরেন সমকালের কাছে। তারা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। তারা কোনো দাবি করতে পারে না। তবে চাহিদা তো সবারই থাকে। সেই চাহিদা থেকেই কিছু প্রত্যাশা রয়েছে তাদের। এসব চাহিদা ও প্রত্যাশা পূরণ হলে কাজের গতি আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
কনস্টেবলরা জানান, তাদের ডিউটি সময় অন্যান্য চাকরির চেয়ে অনেক বেশি। ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয় তাদের। যারা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ব্যারাকে থাকেন, তাদের সকালে ডিউটি শুরু হলে ঘুম থেকে উঠতে হয় রাত ৪ টায় এবং ডিউটি শেষ করে বিছানায় যেতে বাজে রাত ১০টা থেকে ১১টা। ভোরে সকালের খাবার খেয়ে বের হতে হয় তাদের। রাতের ডিউটি করতে হলে ডিউটিস্থলে পৌঁছাতে হয় সন্ধ্যায়। সে ক্ষেত্রে তাদের ডিউটি শেষ হয় পরদিন সকালে। ২৪ ঘণ্টা মধ্যে মাত্র ৪/৫ ঘণ্টা তারা ঘুম কিংবা বিশ্রামে থাকতে পারেন। থানা পুলিশেরও প্রায় একই অবস্থা। ডিউটির সময় একটু কমলে তাদের শারীরিক ক্লান্তি দূর হতো। কাজকর্মে উদ্দীপনা বাড়ত।
আত্মীয়-স্বজনের অনুষ্ঠানেও ঠিকমতো অংশ নিতে পারেন না তারা। এ ছাড়া তাদের নৈমিত্তিক ছুটি বছরে ২০ দিন, যার সব তারা কাটাতে পারেন না। কারণ কাজের চাপ থাকায় এসব ছুটি তাদের ঠিকমতো দেওয়া হয় না। এমনকি অর্জিত ছুটি ২৮ দিন নিতেও নানা সমস্যা হয়। অবশ্য এ ছুটি না কাটালে তারা অতিরিক্ত টাকা পেয়ে থাকেন। যেহেতু কনস্টেবলদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই, সেহেতু সরকার থেকে পাওয়া ছুটিগুলো ঠিকমতো পেতে চাইছেন তারা। এতে তারা তাদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। ঝুঁকি ভাতা বাড়ানো ও ‘ফ্রেশ মানি’ দেওয়ার কথাও বলেন তারা। আর্থিক সংকট কাটাতে পর্যায়ক্রমে বিদেশে মিশনে যাওয়ারও ইচ্ছে পোষণ করেন তারা।
পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কর্মরত কনস্টেবল ফরহাদ হোসেন, রুবেল শেখ ও ইকরাম হোসেন গতকাল কাকরাইল মসজিদ এলাকায় ডিউটিতে ছিলেন। তারা বললেন, ঝুঁকি ভাতা একটু বাড়লে তাদের জন্য সুবিধা হয়। গতকাল দুপুরে পুলিশ ভবন ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল শরিফুল ইসলাম বলেন, তার দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে পড়ে একাদশ শ্রেণিতে। আরেক ছেলে এবার নার্সারিতে ভর্তি হয়েছে। বেতনের টাকায় চলতে তার হিমশিম খেতে হয়। তিনি জানান, একবার যদি তিনি মিশনে যেতে পারতেন তাহলে হয়তো তার আর্থিক সংকট কেটে যেত। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে কর্মরত কনস্টেবল লিটন সুতার বলেন, ঝুঁকি ভাতা বাড়ালে ও ছুটিগুলো নিয়মিত দিলে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়। পিওএম-এর কনস্টেবল মারুফ হাসানও অভিন্ন কথা বলেন।
বিভিন্ন ব্যারাকে থাকা কনস্টেবলরা জানান, পুলিশ সদস্য সংখ্যার তুলনায় ব্যারাকের সিট অনেক কম। এ কারণে একই সিটে ২-৩ জন থাকতে হয়। রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও ট্রাফিক ব্যারাকে থাকা একাধিক কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়. দিনভর ধুলো-বালি আর বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার ভেতর ডিউটি শেষে ব্যারাকে ফিরে অমানবিক পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। একটা কাঠের চৌকির সঙ্গেই আরেকটা চৌকি পাতা। তার এক পাশে একটি করে ট্র্যাংক (টিনের বাক্স), যেটির মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখেন তারা। মাথার ওপরে দড়িতে ঝুলানো তাদের পোশাক। অবর্ণনীয় কষ্টে প্ল্যাটফর্মের মতো রাত কাটাতে হয় তাদের।
সূত্র,- সমকাল