চায়ের ইতিবৃত্ত: রফিকুল ইসলাম সরকার
সাহিত্য ডেস্ক, আমাদের ভোলা ।
==========
বাংলার মাটি পলিমাটি সমৃদ্ধ হওয়ায় সড়ক পথ নির্মাণে ব্যয় সাপেক্ষ ছিল তাই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাঙলায় রেল পথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। রেলপথ স্থাপনের জন্য কমমূল্যে যাহাতে শ্রমিক পাওয়া যায় সেটি নিশ্চিত করতে তৎকালীন আসাম সরকারের সহায়তায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করে।
বিহার, উড়িষ্যা (ওডিশা), মাদ্রাজ (চেন্নাই), নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশ অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে শ্রমিককে নিয়ে আসা হয় রেলপথ নির্মাণের কাজের জন্য। রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষে তাঁরা আর দেশে ফিরে যেতে না চাওয়ায় তাদের কে সিলেট~আসাম অঞ্চলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । উদ্দেশ্য সেখানে বন জঙ্গল পাহাড় পর্বত পরিস্কার করে বসতি স্থাপন ও চা বাগান তৈরির করা।
ঠিক কবে ভারতবর্ষে চা চাষ শুরু করা হয়েছিল তার সঠিক দিন না জানা গেলেও ধারনা করা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আসামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই প্রথম চা চাষ শুরু করে। কেহ কেহ বলেন ১৮৫৪ সালের দিকে সিলেটের মালনি ছড়া এলাকায় প্রথম চা চাষ শুরু হয়।
অন্য তথ্যে জানা যায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বেঙ্গল-আসাম রেলপথ স্থাপনের কাজ শেষ হলে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, রংপুর প্রভৃতি জেলা থেকে লাখ লাখ বাঙালি কৃষিজীবী, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান সম্প্র দায় ভুক্ত, তাঁদেরকে কলোনাইজেশন স্কিমের আওতায় তৎকালীন সিলেট আসামের বিভিন্ন স্থানে অনাবাদি জঙ্গলাকীর্ণ জমি চাষাবাদের ব্যবস্থা করা হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুটো উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য শ্রকিদের সিলেট- আসাম অঞ্চলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
এক, বন জঙ্গল পাহাড় কেটে তাঁদেরকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে সেখানে জনবসতির ব্যবস্থা করা
দুই, চা বাগান করা।
“গাছ হিলেগা তো রুপিয়া মিলেগা” স্লোগানে মোহিত করে তাদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করে এ কাজে আনা হয়।
এ সকল চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে যাহাতে একক নেতৃত্ব বিকোশিত না হয় সেজন্য বাগান সমুহে বিভাজন সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিটি বাগানেই দশ শতাংশের মত স্থানীয় বাঙালী রাখা হতো আর বাকিভাগ হতো অন্যরা, যারা উড়িষ্যার উড়িয়া, মধ্যপ্রদেশ বিহারের বিহাড়ির দলিত শ্রেনী।
কিছু শ্রমিক নেপাল ও শ্রীলংকা থেকেও আনা হয়েছিল, এঁরা ছিল নিম্ন বর্ণের সনাতন পন্থী। এঁরা ছিল ভীষন পরিশ্রমি ফলে বাগান গুলোতে ক্রমান্বয়ে এঁদের অধিপত্যই বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে।
এটি ঠিক যে বৃটিশ, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃকই এদেশে প্রথম চা চাষ শুরু করা হয়। তাঁরা ঐ সময় জানতে পারেন সিলেট আসাম অঞ্চলে এক ধরনের পাতা পাওয়া যায় যা চিবায়ে খেলে শরীরে সতেজ ভাব আসে। এ খবর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছাড়াও সারা এলাকার মানুষের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পরেছিল তখন। বৃটিশরাও ছিল খুবই চতুর ও চালাক প্রকৃতির, তাই তারাও খবরটি লুফে নেয়।
এভাবেই একসময় এ দেশে চা পাতা দিয়ে চা বানানোর বিষয়টি আবিস্কার হয় এবং এদেশে চা চাষের গোড়া পত্তন হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
প্রথমদিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লোক জন নিজেরা চা বানিয়ে বাজারে বাজারে বিনামূল্যে মানুষদের খাওয়াতো। তারপর চা কে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তাঁরা তখন একটি বিজ্ঞাপনও প্রচার করতো আর তা হলো:
ইহাতে নাই কোন মাদক দোষ
ইহা খেলে চিত্ত হয় পরিতোষ
বিজ্ঞাপনে তাঁরা চা কিভাবে মেশাতে হয় বা চা কিভাবে বানাতে হয় ইত্যাদি নিয়মও তারা শেখাতেন। উল্লেখ্য প্রথম চায়ের যে দাম ধরা হয়েছিল তা ছিল প্রতিকাপ এক পয়সা।
চা বাগান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রথমে ব্রিটিশ পরবর্তীতে পাকিস্থানী ও বর্তমানে দেশীয় মালিক কর্তৃক পরিচালিত হলেও শ্রমিকদের সাথে প্রভু ভৃত্তের যে আচরণ করতেন ব্রিটিশ ও পাকিস্থানীগণ অদ্যবধি তা বিদ্যমান রয়েছে বাগান সমুহে।
প্রচলিত, বাগানের ম্যানেজার যখন বাগান পরিদর্শনে যাবেন তার হাতে থাকবে একটি ছড়ি আর সকল শ্রমিকগণ প্রনামের ভঙ্গিতে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। ম্যানেজারের ডাক বাঙলো থেকে কেহ নির্যাতিত না হয়ে ফিরেছে এমন নজীর বাগানের ইতিহাসে নেই। একারনে বাঙলোয় ডাক পড়লে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও কান্নার রোল পড়ে যেত।
চা শ্রমিকদের দূর্ভাগ্য যে মালিক ব্রিটিশ থেকে পাকিস্থানী, পাকিস্থানী থেকে বাঙালী হয়েছে কিন্তু তাদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচররণ ব্যবহার তার কোন পরিবর্তন হয়নি আজো।
উল্লেখ্য শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্র মতে, দেশে চা জনগোষ্ঠী প্রায় ৭ লাখ। তার মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় ৯৪ হাজার, অনিয়মিত শ্রমিক রয়েছে প্রায় আরও ৪০ হাজার।
খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি পারিশ্রমিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেও। প্রতিদিন এক জন চা শ্রমিককে কমপক্ষে কুড়ি থেকে পঁচিশ কেজি পাতা তুলতে হয়। যা থেকে চা হয় প্রায় দশ কেজি। যার মূল্য কমপক্ষে পাচ হাজার টাকা। অথচ একজনের মজুরি মাত্র একশত দু টাকা প্রতিদিন ।
একজন চা শ্রমিকের সাপ্তাহিক বেতন ৭১৪ টাকা। এছাড়া সপ্তাহে দেওয়া হয় ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম চাল বা আটা (বাজার দর হিসেবে যে পণ্যের দাম কম)। যা খুবই কম, দেশের অন্যন্য খাতের শ্রমিকদের তুলনায়।
মজুরি বৃদ্ধির দাবি সহ কোন দাবী এখানে গ্রহনীয় নয়, মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ, রেশন সুবিধা পর্যাপ্ত নয়, বাচ্চাদের জন্য লেখাপড়ার স্কুলের অভাব, চিকিৎসা সুবিধা নেই। মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু এখানে অনেক বেশি। অধিকাংশ চা শ্রমিক পুষ্টিহীনতায় ভুগে থাকেন। জীবন ও জীবিকায়, অধিকারহীনে যেন চা বাগানে শ্রমিকদের নিত্যকার হাহাকার।
চা শ্রমিকগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাদের কোন স্বীকৃতি নেই। ট্রেড ইউনিয়ন সহ সব রকমের শ্রম আইন এদের জন্য প্রযোজ্য নয়। নেই কোন পেনশন সুবিধা।
উত্তরাধিকার সুত্রেও এদের কোন সহায় সম্পত্তি নেই।
চা শ্রকিদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি থাকলেও তাদের নিজস্ব জাতি সত্তার পরিচয় নেই। অথচ তারা যখন স্থানান্তর হয়ে এখানে আসেন তখন ছিল অখন্ড ভারত বর্ষ।
জাতির পিতা তাদেরকে ভোটাধিকার স্বীকৃতি দিলেও প্রকৃত স্বাধীনতা বা অর্থনৈতিক মুক্তি তাদের এখনো অর্জিত হয়নি।
নীতি নির্ধারনী সহ বড় বড় পলিসি মিটিংএ চা দ্বারা আমন্ত্রিত অতিথিগণ সবাই আপ্যায়িত হলেও চা শ্রমিকদের জন্য আজো কোন নতুন নীতিমালা প্রবর্তিত হয় নি। হয়নি কোন নিয়মের পরিবর্তন। বাস্তবায়িত হয়নি মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনাও।
মানুষ, মানবতা ও মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনা চা শ্রমিকদের জীবনে বাস্তবায়িত হোক এ প্রত্যাশায়।
লেখকঃ
রফিকুল ইসলাম সরকার (সুপ্তকূঁড়ি)
(ছড়াকার, কবি, কলামিস্ট, উন্নয়ন কর্মী)