হালের লাঙ্গল-গরু কেবলই ছবি: ভাঙারিতে পাওয়ার টিলার!
আলম রায়হান।
বরিশালে আটকা পড়ে আছি প্রায় দেড় মাস হয়ে গেলো। করোনা তান্ডবে লকডাউন হবার আগেই এসেছিলাম বরিশালে। সেই সময় আমার গ্রামের বাড়ি এবং স্ত্রী অসুস্থ থাকায় শ্বশুর বাড়ির গ্রামে কয়েকবার গিয়েছি। যে দিকেই চোখ যায়, ধান চাষের জমি অনাবাদী। স্থানীয় ভাষায়, খিল। ভয়ানক এ দৃশ্য কেবল দেখেছি। বিষয়টি তেমন ভাবনায় আসেনি। বরং রাজধানীর কংক্রিটের জঙ্গলের চেয়ে খোলা প্রান্তর এক রকম ভালো লাগার অনুভূতি হয়েছে। কিন্তু এই অনুভূতি স্থায়ী হয়নি।
উল্টো ভাবনায় পড়েছি, যখন করোনা মহামারির কারণে বিরাজমান ভয়াবহ সংকট বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ গুরুত্বারোপ খুবই সঙ্গত। এবং এ রকম গুরুত্বারোপ বর্তমান সরকার শুরু থেকেই করে আসছে। যার সূচনা করেছে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার সরকার গঠন করার পর থেকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন।
কৃষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অব্যাহত গুরুত্বারোপ, মতিয়া চৌধুরীর মতো দক্ষ মন্ত্রী দশ বছর কৃষিমন্ত্রণালয় চালাবার পর বর্তমানে মেয়াদে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়েছে ড. আবদুর রাজ্জাককে। যিনি নিজে কৃষিবিদ এবং ২০০৮-এ আওয়ামী সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। কৃষিমন্ত্রী হিসেবে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। আর তাঁর সততা এখনো মাইল ফলক হয়ে আছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। অথচ এ মন্ত্রণালয় দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত। সেই মন্ত্রণালয়ের ইমেজ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছিলেন ড. রাজ্জাক। এদিকে কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামানের সততা ও দক্ষতা সুবিদিত। তা না হলে আর যাই হোক, মতিয়া চৌধুরী তাঁকে কৃষি সচিব হিসেবে গ্রহণ করতে চাইতেন না। আর বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাকও রাখতে অনীহা প্রকাশ করতেন। কিন্তু এমনটা হয়নি। বরং দুজনই বর্তমান কৃষি সচিবকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয়, অনেকেই কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামানকে কৃষিবিদ মনে করেন।
ফলে করোনা মহামারি পরিস্থিতে খাদ্য উৎপাদনের ওপর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন তখন আশাবাদী না হওয়ার আর কোন কারণ থাকে না। আশাবাদী হতেই হয়। কিন্তু হতাশা অন্যখানে। ধানের জমি চাষ হবে কী দিয়ে? খবর নিয়ে জানা গেছে, কেবল অলাভজনক হয়ে পড়া নয়, চাষ দেওয়ার উপকরণের অভাবেও বরিশাল অঞ্চলে ধান চাষ উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। যে চরের ধান নিয়ে এক সময় প্রভাবশালীদের মধ্যে যুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হতো, হতাহত হতো অনেক। সেই চরে বহু বছর ধরে ধান চাষ হয় না। কিছু জমিতে কিছুকিছুু মওসুমী ফসল চাষ হয়। বাকি কেবল ধু-ধু বালুচর। সেতুর প্রভাবে পদ্মার চর যেমন! জমি অনাবাদী থাকা কেবল বরিশালে নয়। গোটা দেশেরই একই চিত্র, কম বেশি।
প্রধানত, ধানের মূল্য না পাওয়ায় ধান চাষ কমেছে। এর পিছনেরও মাফিয়া চক্কর আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাষের উপকরণের অভাব এবং কর্তনে শ্রমিক না পাওয়া। ধান কাটার সময় শ্রমিক না পাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসছে কয়েক বছর ধরে। এ বিষয়ে ফটোসেশনও হয়। এবার এ চক্করে অনেক কৃষকের ধানের বারোটা বেজেছে। ধানকাটা নিয়ে শ্রমিক সংকটের ডামাডোলে জমি চাষ করার জন্য উপকরণের সংকটের বিষয়টি রয়ে যায় আড়ালেই। হয় তো এ ক্ষেত্রে মাফিয়া সর্বনামের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে গেছে। এ নিয়ে মাফিয়াদের ভাবার আর কিছু নেই। এখন কেবল ধান কাটা মেশিন কৃষকের গলায় ঝুলাতে পারলেই হলো। যেমনটা করা হয়েছে ট্রাকটর ও পাওয়ার টিলারের বেলায়। যা বহু আগে কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে গেছে। এদিকে হালের লাঙ্গল-গরু হয়ে গেছে কেবলই ছবি!
জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর ততটা বাজার না পেলেও সরকারি প্রচারণায় পাওয়ার টিলার কৃষকের ঘওে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলো। আর কেবল প্রচারণা নয়, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের নামে পাঁচ বছর মেয়াদে এক প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩৫ হাজার পাওয়ার টিলার কৃষকদের হাতে পৌঁছানো হয়েছে। বেশিরভাগ দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে, আর বাকিটা দেওয়া হয়েছে নামমাত্র মূল্যে। এ সময় অনেক মুখরোচক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই এগুলো ভাঙারির দোকানে চলে গেছে। আর এ জন্য সরবরাহকারীদেরও দোষ দেবার উপায় নেই আইনের দৃষ্টিতে। কারণ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে এর মেয়াদও ছিলো দুই বছর। কি অদ্ভূত চুক্তি। এরপর খেল খতম পয়সা হজম!
এদিকে বিপদে পড়েছেন প্রান্তিক কৃষকরা। ২০১৪-১৯ সাল, পাঁচ বছর মেয়াদে প্রকল্পের অধীনে বিনা মূল্যে এবং নামমাত্র মূল্যে কৃষকদেরকে দেয় প্রায় ৩৫ হাজার পাওয়ার টিলার দুই বছরের মধ্যেই ‘মায়ের ভোগে’ চলে গেছে! এর গন্তব্য ভাঙারির দোকান; বাতিল রিকসা-সাইকেলে সঙ্গে সহঅবস্থান। এ নিয়ে অবশ্য তেমন কোন ক্ষোভ ধূমায়িত হয়নি। কারণ সরকারি পাওয়ার টিলারের বেশির ভাগই গেছে টাউট শ্রেণির হাতে। তারা যা পেয়েছে তাতেই খুশি। কিন্তু সর্বনাশ হয়েছে ধানচাষ ব্যবস্থাপনার। এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবার আগেই সরকারের পাওয়ার টিলার সরবরাহ ‘সমাপ্ত’ হয়েছে। এ নিয়ে আছে নানান অনিয়মের অভিযোগ। অবশ্য এই প্রকল্পের এক কর্মকর্তাকে সম্প্রতি সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
যান্ত্রিক চাষের অতি প্রচারণা এবং চকচকে ‘মেশিন গরু’-এর মোহে হাজার বছরের চাষের লাঙ্গল-গরু হয়েছে অবহেলিত। কৃষকের প্রবণতা পাল্টে গেছে। হালের বলদ চলে গেছে কসাইর কাছে। বাকি যায় কুরবানির হাটে। এই সুযোগে বাজার ছেয়ে গেছে নিন্মমানের পাওয়ার টিলারে। সরকারি প্রচারণায় হালের বলদ ছেড়ে যারা বাজার থেকে পাওয়ার টিলার কিনেছেন তারা আছেন মহাবিপদে। কারণ এগুলো সঠিকভাবে কাজ করে না। আর একটি ছাড়া আর কোন কোম্পানি পাওয়ার টিলারের কোনো ওয়ারেন্টি দেয় না। বাজার থেকে পাওয়ার টিলার কিনে বিপাকে পড়া কৃষকদের ব্যাপারে দৈনিক ইত্তেফাকে ২০১৮ সালের ৭ মার্চ একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক ভয়াবহ।
আধুনিক পদ্ধতিতে যান্ত্রিক চাষ করার প্রচারণার ফাঁদে পড়ে নিম্নমানের পাওয়ার টিলার কিনে কৃষকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক ডিলার পাওয়ার টিলার বিক্রি করার পরে বিক্রয়োত্তর সেবা দেয় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব পাওয়ার টিলারের যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকরা আছেন চরম সংকটে। প্রায় সারাদেশের কৃষকরাই একই অবস্থায় মধ্যে রয়েছে। পাওয়ার টিলার বিক্রয়ের পর কোম্পানিগুলো আর বিক্রয়োত্তর সেবা দেয় না। ফলে মুনাফার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে নানান ঝক্কি। ঘনঘন চেইন ও গিয়ার বক্স পরিবর্তন করতে হয়। তাছাড়া অনেক সময় যন্ত্রাংশ খোলা বাজারে পাওয়া যায় না। এদিকে কমদামের ফাঁদেও পড়ছেন কৃষকরা। দামকম বলে যেগুলো কৃষকদেরকে গছিয়ে দেয়া হচ্ছে সেগুলোর জ্বালানি খরচ অনেক বেশি। অন্যদিকে এর চেইনও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। কিছুদিন পরই চেসিসটি পরিবর্তন করতে হয়। ফলে সস্তায় পাওয়ার টিলার কিনে কৃষকরা পড়েছেন তিন অবস্থায়!
উল্লেখ্য, বগুড়া পল্ল¬ী উন্নয়ন একাডেমি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি বিভাগের যৌথ জরিপের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ব্যবহার্য পাওয়ার টিলারের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। বছর প্রায় ৫০ হাজারের বেশি পাওয়ার টিলার আমদানি করা হচ্ছে। পাওয়ার টিলারের বাজারে ৭০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে চিটাগাং বিল্ডার্স লিমিটেড। এই মনোপলির বিষয়টিও রহস্যজনক।
কৃষিখাতে নানান সীমাবদ্ধতার পরও স্বীকার করতেই হবে, জাতি ও দেশের কৃষির ভাগ্য ভালো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। মতিয়া চৌধুরী ও ড. আবদুর রাজ্জাককে কৃষিমন্ত্রী করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কৃষির অবস্থা হতো আদমজী জুট মিলের মতো। বিএডিসি দিয়ে যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলো খালেদা সরকার। এরপরও কথা হচ্ছে, কৃষিতে বিশ্ব মাফিয়াদের আগ্রাসন প্রতিরোধের বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন। মাফিয়ারা কিন্তু বাংলাদেশের কৃষিকে অনেকখানি খামচে ধরে আছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ‘দুরন্ত এক শকুনের মতো!’লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।