লাইলাতুল কদর: অজস্র ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হওয়ার রাত
ইসলাম ডেস্ক, আমাদের ভোলা.কম।
একবার আয়েশা (রা.) নবীজিকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে কী দুয়া করব?’ তখন নবীজি (সা.) এই দুয়াটি শিখিয়ে দিলেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল! ক্ষমা করতে তুমি ভালোবাস।
আমাদের তুমি ক্ষমা করো’ (ইবনে মাজাহ)। লাইলাতুল কদর একটি মহিমান্বিত রাত। এ রাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিবরাইল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। এ রাতের প্রশান্তি ফজর পর্যন্ত বর্ষিত হয়’ (সূরা কদর)।
লাইলাতুল কদর কোরআন নাজিলের রাত। ওই ব্যক্তির চেয়ে ভাগ্যবান আর কে হতে পারে, যে এ রাতে নির্ঘুম থেকে ইবাদতে কাটিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদতে কাটিয়ে দিল, সে যেন তিরাশি বছর চার মাসের বেশি সময় ধরে মহান আল্লাহর ইবাদত করল। তাফসির গ্রন্থে রয়েছে- নবীজি (সা.) একদিন সাহাবায়ে কেরামদের সামনে বনি ইসরাইলের এক ইবাদতগুজার মানুষের কথা বলছিলেন। সে ব্যক্তি দিনে জিহাদ করত এবং রাতে এক হাজার মাস ধরে আল্লাহর ধ্যান সাধনায় ডুবে ছিল। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আফসোস করতে লাগলেন, আমরা এত বছর ইবাদত করব কীভাবে? আমরা তো সেই দরবেশের মতো শ্রেষ্ঠ হতে পারব না। ঠিক তখনই জিবরাইল (আ.) সূরা কদর নিয়ে হাজির হলেন (তাফসিরে মাজহারি)।
লাইলাতুল কদর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার রাত। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোয় লাইলাতুল কদর তালাশ করো’ (বুখারি)। হাদিসের অনেক ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায়- নবীজির আমলে অনেক সাহাবি রমজানের ২৭ তারিখকে লাইলাতুল কদর হিসেবে স্বপ্ন দেখেছেন। সাহাবিরা নবীজিকে স্বপ্নের কথা জানালে নবীজি বলেন, আমিও এমনটা স্বপ্নে দেখেছি। হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি- নবীজি (সা.) রমজানের ২৭ তারিখের রাতকে লাইলাতুল কদরের রাত বলেছেন।’ অন্য হাদিসে রয়েছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা কোনো কারণে অক্ষম হয়ে থাকে, সে যেন রমজানের ২৭ তারিখ রাতে ইবাদত করে’ (মুসলিম)।
অনেক বিজ্ঞজনের মতে, লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমজানের ২৭ তারিখে। তারা বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দ দুটিতে ৯টি বর্ণ রয়েছে, আর সূরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দ দুটি তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে ফলাফল হয় সাতাশ। তাই ছাব্বিশতম রোজার দিবাগত রাত সাতাশ রমজানের রাতই হল লাইলাতুল কদর রাত। (তাফসিরে মাজহারি)। আবার অনেকের মতে, বছর ঘুরে লাইলাতুল কদরের তারিখ পরিবর্তন হয়। কোনো বছর একুশ, কোনো বছর তেইশ, কোনো বছর পঁচিশ, কোনো বছর সাতাইশ, আবার কোনো বছর উনত্রিশ তারিখের রাতে লাইলাতুল কদর হয়।
লাইলাতুল কদরের রাতের বিশেষ কিছু নিদর্শন রয়েছে। এ রাতে অন্ধকার গভীর হবে না। আলো-আঁধারি ছেয়ে থাকবে। অধিক গরম হবে না। শীতের তীব্রতাও থাকবে না। হালকা বাতাস প্রবাহিত হবে। ইবাদতে মানুষ তৃপ্তি লাভ করবে। এ রাতে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ভোরে সূর্য উদয় হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো স্নিগ্ধ আলো নিয়ে। লাইলাতুল কদরকে গোপন রাখা মহান আল্লাহর মহা রহস্য। তিনি চান তার বান্দা লাইলাতুল কদর অন্বেষণেও সাধনা করুক। ওলামায়ে কেরাম বলেন, লাইলাতুল কদর যদি অনির্দিষ্ট রহস্যময় না হতো, তাহলে অনেক অলস ও হতভাগা লোক এ মহান রাতের অমর্যাদা করে আল্লাহর গজবে পড়ত। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে আত্মকল্যাণের উদ্দেশ্যে এ রাতে জেগে থেকে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (বুখারি)।
লাইলাতুল কদরে সূর্যাস্তের পরপরই আল্লাহ প্রথম আকাশে নেমে আসেন। মায়া আর দয়া নিয়ে, প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে মানবজাতিকে ডাকেন আর বলেন, ‘কে আছ পাপী! তুমি ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। কে আছ দুঃখী! আমি তোমার দুঃখ দূর করব। কে আছ রোগী! আমি তোমাকে সুস্থ করে দেব। কে আছ দায়গ্রস্ত! আমি তোমাকে দায়মুক্ত করে দেব। তোমাদের কার রিজিকের প্রয়োজন! আমার কাছে চাও, আমি তার রিজিক বৃদ্ধি করব।’ মহান আল্লাহ এভাবে ফজর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন। যারা তার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রার্থনায় ডুব দেয়, তারা কল্যাণকামী হয়। সৌভাগ্যবান হয়। মহান আল্লাহ এ রাতে বান্দার জীবন, মৃত্যু ও তকদির চূড়ান্ত করে দেন।
লাইলাতুল কদরে মুমিন বান্দা কিছু নফল ইবাদত করবে। ধীরগতিতে নফল নামাজ পড়বে। তাকওয়া ও স্থিরতার সঙ্গে রুকু-সেজদা করবে। বারবার মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। এ রাতে যে মুমিন বান্দা অনেক কিছু পেল, কিন্তু ক্ষমা পেল না; তাহলে তার চাওয়া-পাওয়া সবই ব্যর্থ হবে। তার জীবন পুরোটাই অনর্থ হবে। একজন মুমিনের কাজ হবে, এই পবিত্র রাতে মহান আল্লাহর কাছে নিজের দুঃখ-কষ্টগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য ভিক্ষা চাওয়া- হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমাদের আপনি করোনামুক্ত পৃথিবী ফিরিয়ে দিন।
সূত্র যুগান্তর