সিরিজ অগ্নিকান্ডের নেপথ্যে অন্য খেলা নেই তো!
আলম রায়হান: জেষ্ঠ সাংবাদিক।
আগুণ থেকে তো কিছুই বাদ যাচ্ছে না! নগরীর পুরনো ঘিঞ্জি এলাকা থেকে কথিত আধুনিক এলাকার বনানীর বহুতল ভবন, পাটের গুদাম- আগুণের গ্রাস যাচ্ছে। আগুণ আতংকে রয়েছে মানুষ। বিষয়টি সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক ঘটনায় এও ভেবে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ সব অগ্নিকান্ডের নেপথ্যে অন্য কোন খেলা নেই তো! স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে কত খেলাই তো খেলা হয়েছে এ পর্যন্ত। আবার বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর নানান ধরণের বানিজ্য ধান্ধাও থাকে নানান অঘটনের নেপথ্যে। এসব আসলে অন্ধকারে কালো বিড়ালের মতো বিষয়। অন্ধকারে কালো বিড়াল ধরা তো অনেক দূরের কথা, চিহ্নিত করাও কঠিন।
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৭১ জনের প্রাণহানির রেশ কাটতে না কাটতেই ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণ গেছে আরও ২৬ জনের। একদিন পর গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের পাশের কাঁচাবাজার পুড়েছে ৩০ মার্চ। একই দিন রাতে পুড়েছে নরসিংদির পাটের গুদাম। আর আগুন লাগলেই সেটিকে স্রেফ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বলে পারপাবার চেষ্টা চলে। শর্ট সার্কিট যেনো দায়মুক্তির আওতায় আছে। বহুতল ভবনগুলো কীভাবে গড়ে উঠছে, সেখানে অগ্নি নির্বাপণের নিজস্ব ব্যবস্থা আছে কি না, তার জবাবদিহিতা কোথায়? তা কেউ কার্যকরভাবে খতিয়ে দেখে না। এবার খতিয়ে দেখার জন্য রাজউক কোমর বেধে নেমেছে। কিন্তু যে সংস্থার থাকার কথা আসামীর তালিকায়, সেই নেমেছে পুলিশের ভূমিকায়। ফলে ফলাফল সম্পর্কে আগেভাগেই একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে অনেকের। এদিকে রাজউকের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর নতুন বানিজ্যের স্বর্ণদ্বার খুলে গেলো কিনা তাও একটি বড় প্রশ্ন। এসব মোটেই স্বস্তির নয়, সরকারের জন্য। অতীতে যাই হয়ে থাক না কেন, বর্তমান সরকারের কাছে জনপ্রত্যাশা বিরাট। এ প্রত্যাশা পুরণে হোচট খেলে সঙ্গত কারণেই তার প্রতিক্রিয়াও হবে ভয়ানক।
প্রতিটি ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, একাধিক কমিটিও হয় একএকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। প্রতিবারই বহু সুপারিশ আসে। হয়তো, একই সুপারিশ বারবার কপি পেস্ট করা হয়। কিন্তু কোনটিই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে জানা যায়নি। চরম এই দৈন্যতার ফলে বারবার আগুনের লেলিহান শিখা নিজের ভয়ংকর দাপটের জানান দেয়। ফলে, প্রকৃতির নিয়মে এক সময় যার কবরে যাবার কথা ছিলো সে জ্বলে চিতার চেয়েও ভয়ানক আগুণে! যাকে চিতায় নিয়ে যাবার বিধান আছে তার হয়তো লাশই মেলে না। এই হচ্ছে খোদ রাজধানীর চিত্র।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মতে গত পাঁচ বছরে ৮৯ হাজার ৯২৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮ হাজার ১৩টি ঘটেছে রাজধানীতে। এ হচ্ছে প্রাণহানী এবং ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ আকার ধারনা করা অগ্নিকান্ডের ঘটনার পরিসংখ্যান। ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত খবর পৌছানোর আগে যেগুলো নিভানো যায় তা রয়েছে এ পরিসংখ্যানের বাইরে। আর এক পরিসংখ্যান মতে, রাজধানীর নব্বই শতাংশ ভবন অগ্নি ঝুকিতে আছে। মমতাজের জনপ্রিয় একটি গান আছে, ‘পোলা তো নয় যেনো আগুণেরই গোলা।’ এ আদলে বলা যায়, রাজধানীতে মানুষ আসলে ‘আগুণের গোলার’ মধ্যেই বসবাস করে।
পুরান ঢাকার নীমতলী থেকে চুরিহাট্ট, এরপর কথিত আধুনিক ঢাকার বনানীর বহুতল ভবন এবং গুলশানের কাঁচা বাজার- সবকিছুই আগ্নিকান্ডের ঝুকিতে। অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে বারবার। সবারই জানা, একটা সিগারেট থেকে আর একটা সিগারেটে যারা অগ্নি সংযোগ করেন তাদেরকে বলা হয় চেইন স্মোকার। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একের পর এক অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে কি বলা যায়? আমাদের গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, হত্যাকান্ড। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায় কার! মনে হচ্ছে, এ দায় সার্বজনীন। তবে প্রধান দায় রাজউকের। যা পূর্তমন্ত্রীর অধীন।
একের পর এক এই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অগ্নিনির্বাপনে স্থাপনাগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের সংস্থাগুলোর দায়িত্বে অবহেলার প্রসঙ্গও আসছে ঘুরেফিরে। আবার পরপর আগুণ লাগার কয়েকটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনা ঘটার পর অনেক কথা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। এন্তার সুপারিশ আসে। অনেক চিঠি চালাচালি হয়। ‘এই করেঙ্গা, সেই করেঙ্গা’ গোছের আওয়াজও দেন অনেকে। এই পর্যন্তই। একসময় সব থেমে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আবার আর একটি অগ্নিকান্ডের পর আবার শুরু হয় স্বল্পকালীন তৎপরতার পুনরাবৃত্তি। এ যেনো, বারবার প্লে করা এক ট্রাজিক শর্ট ফ্লিম!
২০১৭ সালে ডিএনসিসির মার্কেটটিতে অগ্নিকান্ডের পর গুলশান, বনানী ও বারিধারার বাণিজ্যিক ভবন, ব্যাংকের কার্যালয় ও হাসপাতালের অগ্নিঝুঁকি নিরূপণ করতে জরিপ চালায় ফায়ার সার্ভিস। ভবনগুলোর ভূগর্ভস্থ জলাধারের ধারণক্ষমতা, প্রবেশদ্বারের প্রশ্বস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও প্রয়োজনীয় লিফটের অবস্থান জানার জন্য ভবনগুলো পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। জরিপে দেখা যায় এই তিন এলাকার ২০১টি ভবনের অগ্নিকান্ড মোকাবিলার সক্ষমতা নেই। এর মধ্যে ৪৬টি বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে, যার ২১টি বহুতল ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত। বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৮টি কার্যালয়ের মধ্যে ১০৪টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ১২টি হাসপাতালের মধ্যে ১০টিরই অগ্নিকান্ড মোকাবিলার সক্ষমতা নেই।
এরপরও কিছুই করা হয়নি। অবশ্য তেমন কিছু করার আছে বলেও মনে হয় না। কারণ, রাজধানীর বহুতল ও আধুনিক ভবনের নামে যা গড়ে তোলা হয়েছে, তা বস্তুত কংক্রিটের গুহা। মানুষ এইসব গুহায় জীবিকার সন্ধান করে, বসবাসও করে। আর ভবন নামে কেবল কংক্রিটের গুহা বানানোই নয়, এসব ভবনে ন্যূনতম ফায়ার এক্সিট রাখা হয় না। যাও আছে তাও নামকাওয়াস্তে। শুধু তাই নয়, এ ভনগুলো সিড়ির বদলে লিফ্ট নির্ভর করে বানানো হচ্ছে। কোন রকম সিড়ি রাখা হয়, একান্তই রাখতে হয় বলে। ফলে আগুণ থেকে বাঁচার সুযোগ সংকোচিত হয়ে পড়ে। ভবনে আগুন নেভানোর মতো পানিও থাকে না। ভবনের আশপাশে রাস্তায় যে হাইড্র্যান্ট থাকার কথা, তাও নেই। অসংখ্য এই ‘নাই’-এর মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এবং অনেকেই মরে যায় নির্ধারিত সময়ের আগেই।
তবে এবার আমাদের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, “অতীতে অনেক তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু এবার সব তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে আনা হবে। মানবসৃষ্ট কারণে যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” খুবই আশা জাগানিয়া ভাষণ দিয়েছেন আমাদের মন্ত্রী। এ ব্যাপারে আমি একটি প্রশ্ন করতে এবং একটি ছোট গল্প বলতে চাই।
পূর্তমন্ত্রীর প্রতি আমার বিনীত প্রশ্ন, সব তদন্ত প্রতিবেদন
জনসমক্ষে আনা হলে তা থেকে কী ফলোদয়
হবে? মনে রাখা প্রয়োজন, বড় রকমের জনপ্রত্যাশা
হোচট খেলে তার প্রতিক্রিয়াও হয় ভয়ানক!
গনপূর্তমন্ত্রীর প্রতি আমার বিনীত প্রশ্ন হচ্ছে, সব তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে আনা হলে তা থেকে কি ফলোদয় হবে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য নিশ্চয়ই আমাদের বেশ সবুর করতে হবে। সবুরেই নাকি মেওয়া ফলে! তবে কে জানে এরমধ্যেই আবার কোন অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটবে কিনা। না ঘটুক সেই কামনায় প্রচলিত গল্পটি বলে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। গল্পটি এ রকম, “ইন্দিরা গান্ধি একবার রাচির পাগলা গারদ পরিদর্শনে গেছেন। তাকে দেখে এক পাগল আর এক পাগলকে বলছে, জানিস ওনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী! এ প্রেক্ষিতে আর এক পাগল বললো, প্রথম দিকে আমিও নিজকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভাবতাম; কিছু দিন যাক, তার পর এই মহিলাও ঠিক হয়ে যাবে।”
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এ গল্পটি কি কখনো শুনেছেন? না শুনে থাকলে এখন আর না শোনাই বেহেতের। ঝামেলার সময় এইসব ফানী গল্প না শুনে বরং তিনি পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বক্তব্য একটু শোনার চেষ্টা করতে পারেন। আইজিপি বলেছেন, “গত ১৪ বছরে রাজউক কী করেছে? ভবনটি ১৮ তলা হওয়ার কথা অথচ হয়েছে ২৩ তলা। সেটাও ১৪ বছর আগে। তাহলে রাজউক এত দিন কী করেছে।” এফআর টাওয়ারের কাছে ২৯ মার্চ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশ প্রধান এ প্রশ্ন তুলেছেন। অর এ প্রশ্ন কেবল আইজিপি’র নয়, এটি সারা দেশের মানুষের প্রশ্ন।