টোলের মাস্টার মেজাজের ভিসি এযুগে অচল! – আলম রায়হান
আলম রায়হান ॥
প্রাথমিক বিদ্যালয় হেডমাস্টার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি পর্যন্ত এক রকম অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ অবস্থা চলছে বেশ কয়েকবছর ধরে। শিক্ষাকুলের বিরুদ্ধে মহামারি আকারে দেখা দেয়া বিভিন্ন অভিযোগ ছাপিয়ে প্রশাসনিক অদক্ষতার বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠেছে কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। এর অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। পরিস্থিতি ঘোলাটে করে নাকে খত দেবার মতো ভিসির দু:খ প্রকাশ করার পরও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। উল্লেখ্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য ড. এস এম ইমামুল হকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারীরা ভিসির কুশপুত্তলিকাও দাহ করেছেন ।
প্রফেসর ড. ইমামুল হক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরেই নানান বিতর্কে জড়িয়ে আছেন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টাসহ নানান কারণে তিনি আলোচিত-সমালোচিত। সর্বশেষ তিনি সমালোচিত হয়েছেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ‘রাজাকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। সঙ্গত কারনেই তার এই আপত্তিকর মন্তব্য ছাত্র সমাজ গ্রহন করেনি। কিন্তু তিনি জোর প্রয়োগ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তার এই খামলেয়ালী সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মানেননি। শেষতক তিনি প্রকাশ্যে দু:খ প্রকাশ করে একটি আপোষ রফায় পৌছানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে কোন ফল এখনো আসেনি। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভিসি পদত্যাগের দাবিতে চলমান দাবিতে অটল রয়েছেন।
উল্লেখ্য, এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. ইমামুল হকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসাধাচরণসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। এমনকি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য তার পীড়াপীড়ি সংশ্লিষ্ট পুলিশও অতিষ্ঠ বলে জানা গেছে। এই হচ্ছে একজন ভিসির প্রতিকৃতি। এদিকে তার মেজাজ সব সময় গরম থাকে পুরানা জামানার টোলের মাস্টারের মতো। আধুনিক যুগে যা সম্পূর্ণ অচল। সম্ভবত এ কারনেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য, সাবেক সচিব ও গবেষক সিরাজ উদ্দীন আহমেদ অবিলম্বে বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. ইমামুল হককে অপসারণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
গতকাল শনিবার ১০টায় ই-মেইল বার্তায় জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ রুমি স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে উপাচার্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইটেও আছে। এ বিবৃতিতে উপাচার্যের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, “২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমার প্রদত্ত বক্তব্যের একটি বাক্যকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আমি এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকার সম্বোধন করিনি বরং যারা মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে বাঁধা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের এহেন কার্যক্রম রাজাকার সদৃশ মর্মে মন্তব্য করেছি।”
উপাচার্যের বরাত দিয়ে বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়, “উক্ত শব্দটি আমি কোনভাবেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলিনি। এরপরেও যদি আমার উক্ত বক্তব্যে কোন শিক্ষার্থী মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকে, তবে তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল একাডেমিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলমান রাখার স্বার্থে আমি সকল শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা কামনা করছি।”
এদিকে সাবেক সচিব ও গবেষক সিরাজ উদদীন আহমেদ ভিসি পদ থেকে প্রফেসর ড. ইমামুল হকে অপসারণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. হারুন আর রশিদ, অধ্যক্ষ মোঃ হানিফ, সাবেক সচিব সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি আখতারুজ্জামান, সচিব আঃ মালেক, অতিরিক্ত সচিব এস মাহামুদ প্রমুখ।” সাবেক সচিব ও গবেষক সিরাজ উদ্দীন আহমেদ বিবৃতিতে আরো বরেন, “আমাদের চেষ্টায় বরিশালে বিশ্ববিদ্যাল ভবন নির্মান ও শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হয়। আমার উদ্যাগে জিয়াউর রহমান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরিবর্তন করা হয়। আমরা দক্ষতার সাথে ২০১০ সালে থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সুষ্ঠু ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছি। আমাদের সুপারিশ ছিলো ড. ওহেদুজ্জামান চাঁনকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এর ভিসি নিয়োগ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান ভিসিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার কারণে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগতি থমকে দাড়িয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট বরিশালবাসীর আবেদন, নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়-এর ভিসি ওহিদুজ্জামান চাঁনকে বর্তমান ভিসির স্থলে ভিসি নিয়োগ করা হোক।”
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করা হবে, বর্তমান ভিসি অপসারিত হবেন নাকি হবেন না, কাকে নতুন ভিসি নিয়োগ দেয়া হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই সুচিন্তিত বিবেচনা আছে। এ নিয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। আমার বক্তব্য হচ্ছে, টোলের হোডমাস্টার হবারও অযোগ্য কোন ব্যক্তিকে যেনো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি করা না হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, ভিসি একটি জটিল প্রশাসনিক পদ। কারণ, টোলের মাস্টারের মেজাজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা যায় না, এধরণের ভিসি এ যুগে অচল। এটি আবার প্রমানিত হলো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক